বেশ অত্যাচারী শাসক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 বেশ অত্যাচারী শাসক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অর্থসংকটে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে রবীন্দ্রনাথ সে সংকট মেটাতে একটি বসতবাটিসহ স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর প্রায় সমস্ত গয়না বেঁচে দিয়েছিলেন। এতে করে তিনি বউয়ের প্রতি অতি আচার করেছেন অর্থাৎ অত্যাচার করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ নিজ জামাই, বন্ধুপুত্রসহ একমাত্র জীবিত ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কৃষি শিক্ষা নেওয়ার জন্য ১৯০৬ সালে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রায় সোয়াশ বছর আগে অন্যান্য ধনাঢ্য বাঙালির মতো ছেলেকে বিদেশে ব্যারিস্টারি পড়তে না পাঠিয়ে চাষাবাদ শেখাতে কেন পাঠিয়েছিলেন জানেন? আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে চাষ করে যাতে নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত চাষীদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটে। কৃষিতে স্নাতক শেষ করে দেশে ফেরার বছরখানেকের মধ্যে পিতার নির্দেশে রথীন্দ্রনাথ প্রথা ভেঙ্গে বিধবা প্রতিমা দেবীকে হাসিমুখে বিয়ে করেছিলেন, যে বিয়েটি ছিল ঠাকুর বাড়ির ইতিহাসে প্রথম বিধবাবিবাহ। উভয় ক্ষেত্রে পুত্র রথীন্দ্রনাথের ইচ্ছা-অনিচ্ছা জানতে না চেয়ে রবীন্দ্রনাথ পুত্রের প্রতি অতি আচার করেছেন অর্থাৎ অত্যাচার করেছেন। অন্যদের মতো রথীন্দ্রনাথেরও তো ব্যারিস্টারি পড়ার কিম্বা পছন্দের কোনো মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছে থাকতেই পারত।

নিজের পুত্রকে দিয়েই বিধবাবিবাহ বিরোধী পাথরকঠিন প্রথা ভাঙ্গেন রবীন্দ্রনাথ। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর সাথে 'অত্যাচারী শাসক'।

বেশ অত্যাচারী শাসক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রবল ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ একবার নদী থেকে নৌকা নিয়ে একটি খালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঝড়ের প্রকোপ কিছুটা কমে আসলে নৌকার ডেকে হাঁটা-চলা করার সময় হঠাৎ তিনি চিৎকার করে ওঠেন। তিনি মাঝ নদীতে লম্বা চুলবিশিষ্ট আধডুবো এক মানব শরীর দেখতে পেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ডিঙি নিয়ে নৌকার মাঝিদের সেই ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে বললেন। মাঝিদের কেউ ঝড়ের মধ্যে এ কাজ করতে রাজি না হলে রবীন্দ্রনাথ ডিঙিতে লাফ দিয়ে পড়ে নিজেই ডুবন্ত মানুষটিকে উদ্ধারে উদ্যত হলেন। ঘটনাক্রমে পরে আরো কয়েকজন রবীন্দ্রনাথের সাথে উদ্ধার তৎপরতায় শরিক হয়।

উদ্ধারের পর দেখা গেল ডুবন্ত মানুষটি ছিল এক নারী যে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওই নারী রবীন্দ্রনাথেরই এক প্রজার বউ। রবীন্দ্রনাথ ওই প্রজাকে ডেকে নিয়ে বুঝিয়েসুঝিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে বললেন। যতদূর জানা যায়, এরপর থেকে সেই প্রজা আর প্রজাপত্নী সুখে-শান্তিতে ঘর-সংসার করেছিল। তো ঝড়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যখন তিনি প্রজার বউকে মাঝ নদী থেকে উদ্ধার করেন, তখন তিনি নিশ্চয় নিজের প্রতি অতি আচার অর্থাৎ অত্যাচার করেছেন।

এত অত্যাচার যিনি করেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তো আমরা ‘অত্যাচারী’ বলতেই পারি।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারি এস্টেটের নিরক্ষর, শ্রমজীবী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, দারিদ্র্যপীড়িত, ক্ষুধাক্লিষ্ট ও দুর্যোগগ্রস্থ রায়তদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য খাজনা মওকুফ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পানীয় জলের জন্য পুকুর-কূপ খনন, বিদ্যালয়-মাদ্রাসা-ধর্মশালা নির্মাণ ও এসবের সংস্কার করেছিলেন। তিনি নিরলস পরিশ্রমে শিলাইদহে দাতব্য চিকিৎসালয়, পতিসরে হাসপাতাল ও কালীগ্রামে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জমিদারির প্রায় সব টাকাই এই মানুষ পল্লীমঙ্গল ও প্রজাকল্যাণে উদার হস্তে ব্যয় করেছিলেন।

প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশার খোঁজ নিতে সরেজমিনে তাদের সাথে দেখা করতেন এই 'অত্যাচারী শাসক'

মহাজনদের শোষণ থেকে প্রজাদের বাঁচাতে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে পতিসরে কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ ২০ বছর (মতান্তরে ২৫ বছর) সক্রিয় থেকে এ ব্যাংক প্রজাদের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নে অনেকটাই সফল হয়। মহাজনদের সমস্ত ঋণ শোধ করে দিয়ে তারা ঋণমুক্ত সুখী জীবনের সন্ধান পায়। ফলশ্রুতিতে কালীগ্রাম থেকে রক্তচোষা মহাজনরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

আজ থেকে শত বছরেরও বেশি সময় আগে তিনি সহজ শর্তে দরিদ্র কৃষকদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করেছিলেন। কিন্তু দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের ঋণখেলাপ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জের শিকার কৃষি ব্যাংকটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁকে যে দেনাগ্রস্থ হতে হয়েছিল সে দেনা পরিশোধ তত সহজ ছিল না। উপরন্তু Rural Indebtedness আইন প্রণীত হওয়ার কারণে কৃষকদের দেওয়া ঋণ আজ পর্যন্ত অনাদায়ী থেকে গেছে। তো আপনি ভারতবর্ষের এমন কজন জমিদারের কথা জানেন যাঁরা প্রজাকল্যাণ করতে গিয়ে দারুণ ঋণগ্রস্থ হয়েছিলেন?

কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংকের হিসাব খাতা। 'অত্যাচারী শাসক' তাঁর নোবেল বিজয়ের যে লক্ষাধিক টাকা এ ব্যাংকে দিয়েছিলেন, সে হিসেবেও এ খাতায় আছে।

'জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর।' না, এ উক্তি কোনো রাজনীতিক কিম্বা সমাজতন্ত্রীর নয়; এ উক্তি স্বয়ং জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। প্রশ্ন করতে পারেন তবে তিনি জমিদারি আঁকড়ে ধরে ছিলেন কেন? হ্যাঁ, জমিদারির মধ্যে 'মস্ত ফাঁকি' আবিষ্কার করে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি ছেড়ে দেবারও চিন্তা ভাবনা করেছেন। কিন্তু ভারার্পণের জন্য উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পাননি তখনও। তাঁর উক্তিতেই পড়া যাক, ‘মস্ত একটা ফাঁকির মধ্যে আছি। এমন জমিদারি ছেড়ে দিলেই তো হয়? কিন্তু কাকে ছেড়ে দেবো? অন্য এক জমিদারকে? গোলাম-চোর খেলার গোলাম যাকেই গতিয়ে দিই, তার দ্বারা গোলাম-চোরকে ঠেকানো হয় না। প্রজাকে ছেড়ে দেবো? তখন দেখতে দেখতে এক বড়ো জমিদারের জায়গায় দশ ছোটো জমিদার গজিয়ে উঠবে। রক্ত পিপাসায় বড় জোঁকের চেয়ে ছিনে জোঁকের প্রবৃত্তির কোনো পার্থক্য আছে তা বলতে পারি নে।’ ১৯৩৭ সালে পতিসর ছেড়ে চলে চলে যাওয়ার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব সম্পদ প্রজাদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন।

যে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি সত্তাকে কঠোরভাবে শাসন করে দুস্থ মানবসেবায় আত্মনিবেদিত থেকেছিলেন, তিনি তো একজন শাসকই বটে। যে জমিদার জমিদারি ভোগ-বিলাসের প্রবৃত্তিকে কঠিন শাসনে বেঁধে রেখে মানবতাবোধের নজিরবিহীন বিকাশ ঘটিয়েছিলেন জীবনব্যাপী, তিনি তো একজন শাসকই বটে। তো আগে প্রমাণ হলো রবীন্দ্রনাথ একজন 'অত্যাচারী' এবং পরে এও প্রমাণ হলো তিনি একজন 'শাসক'। এই দুয়ে মিলে তাঁকে তো 'অত্যাচারী শাসক' বলাই যায়। আপনার কী মত জানি না; তবে আমার মনে হয় এরকম 'অত্যাচারী শাসক' যদি যুগে যুগে আবির্ভূত হতেন তবে তাঁরা এই পৃথিবীটাকে এত অশান্তিপূর্ণ হতে দিতেন না কিছুতে।

Post a Comment

0 Comments