টাইটান অনুসন্ধানের এখন কী হবে?

টাইটান অনুসন্ধানের এখন কী হবে?

মহাসাগরের তলদেশে যাত্রায় টাইটানের ঠিক কী হয়েছিল? পাঁচজনের লাশের সন্ধান কি মিলবে? এমন নানা প্রশ্ন আসছে সামনে। মহাসাগরের তলদেশে টাইটানের সাবমার্সিবলের কী ঘটেছে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন সামনে আসছে।


টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে সপ্তাহখানেক আগে আটলান্টিক মহাসাগরে নামা ডুবোযান টাইটান যে ধ্বংস হয়ে গেছে, তা নিশ্চিত। পাঁচ আরোহী যে আর বেঁচে নেই, তা নিয়েও নেই সংশয়।

কিন্তু ওই মহাসাগরের তলদেশে যাত্রায় টাইটানের ঠিক কী হয়েছিল? পাঁচজনের লাশের সন্ধান কি মিলবে? এমন নানা প্রশ্ন আসছে সামনে। আলোচিত এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবিও উঠছে।

এখন অনুসন্ধানে কী হবে, তা খতিয়ে দেখেছে বিবিসি।

এই দুর্ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ জানানোদের একজন লুসিকেন্ট, যিনি টাইটানের যাত্রী বিমান সংস্থা অ্যাকশন এভিয়েশনের চেয়ারম্যান ব্রিটিশ ধনকুবের হামিশ হার্ডিং (৫৮) এর নিকট স্বজন।

বিবিসিকে লুসিকেন্ট বলেন, “টাইটানের নিরাপত্তার বিষয়টি আরও পরীক্ষা করা উচিৎ ছিল। কোম্পানি ওশেনগেইটের আরও বেশি করা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিৎ ছিল।

“কী ভুল হয়েছে, কেন এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, কেন তারা বেঁচে নেই, সেটি জানতেই এই ঘটনা পরিপূর্ণ তদন্ত করা উচিৎ।”

লাশ উদ্ধার করা যাবে?

মহাসাগরে টাইটানের যে পাঁচ যাত্রীর সলিল সমাধি ঘটেছে, তাদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হবে কি না, বৃহস্পতিবার তা নিশ্চিত করতে পারেননি মার্কিন কোস্ট গার্ড কর্মকর্তা রিয়ার অ্যাডমিরাল জন মাগার।

অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দেওয়া এই কর্মকর্তা বলেন, “পানির নিচে এক অবিশ্বাস্য রকমের প্রতিকূল পরিবেশ।”

টাইটান সাবমার্সিবলে আরোহী হিসেবে ছিলেন ব্রিটিশ ধনকুবের, বিমান সংস্থা অ্যাকশন এভিয়েশনের চেয়ারম্যান হামিশ হার্ডিং (৫৮), পাকিস্তানের এংরো করপোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাদা দাউদ (৪৮) ও তার ছেলে সুলেমান দাউদ (১৯), ফরাসি পর্যটক পল অঁরি নারজিলে (৭৭)। এছাড়া ওশানগেইটের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টকটন রাশও (৬১) ছিলেন।

অনুসন্ধানের কী হবে?

সাবমার্সিবলের এই ঘটনায় কোনো প্রোটোকল না থাকায় কোন সংস্থা তদন্তের নেতৃত্ব দেবে, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়।

মার্কিন কোস্ট গার্ড কর্মকর্তা জন মাগারও বলছেন, এ বিষয়টি নির্ধারণ করা জটিল, কারণ টাইটানের সলিল সমাধি ঘটেছে আটলান্টিক মহাসাগরের একটি প্রত্যন্ত অংশে, আর ওই ডুবোযানে বিভিন্ন জাতীয়তার আরোহী ছিলেন।

তবে এখন পর্যন্ত যেহেতু মার্কিন কোস্ট গার্ড নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে, তারা এই অনুসন্ধান পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
 
 
টাইটান অনুসন্ধানের এখন কী হবে?
ছবি: রয়টার্স
টাইটান উদ্ধারে যোগ দিল ২০ হাজার ফুট গভীরে যেতে সক্ষম রোবট।

মার্কিন কোস্ট গার্ড বলছে, ধ্বংসাবশেষ এলাকায় তারা অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে। অনুসন্ধান জাহাজ ও প্রযুক্তিবিদরা ঘটনাস্থল এলাকায় রয়েছেন। অন্যান্য দলগুলো কার্যক্রম গুটিয়ে নেবে, তবে সরঞ্জামগুলো প্রত্যাহারের প্রয়োজন পড়ছে না। সাগরের তলদেশে টাইটানিকের চারপাশে পাঠানো রিমোট অপারেটিং ভেহিকলও (আরওভি) থাকবে।

জন মাগার বলেন, “সমুদ্রতলে অপারেশন কখন বন্ধ হবে, সে ব্যাপারে আমার কাছে কোনো সময়সীমা নেই।”

টাইটানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া আরওভি নির্মাতা কোম্পানি পেলাজিক রিসার্চ সার্ভিসেস শুক্রবার বলেছে, ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে ফের তারা সেটিকে সাগরের তলদেশে ম্যাপিং ও তথ্যচিত্র ধারণের জন্য পাঠাচ্ছেন।

ওই কোম্পানির এক মুখপাত্র সিএনএনকে বলেন, আরওভি দিয়ে ওই সাইটে আরও এক সপ্তাহ অনুসন্ধান চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
 
একশ বছরের বেশি সময় আগে সেই ১৯১২ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যাওয়া সেই সময়ের সর্ববৃহৎ জাহাজ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গত রোববার পর্যটকদের নিয়ে ডুব দিয়েছিল পর্যটন সংস্থা ওশানগেইটের ডুবোযান টাইটান। আটলান্টিকের পানিতে ডুব দেওয়ার পৌনে দুই ঘণ্টার মাথায় টাইটানের সঙ্গে পানির ওপরে থাকা নিয়ন্ত্রক জাহাজ পোলার প্রিন্সের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 
তারপর থেকে চলছিল টাইটানের উদ্ধার অভিযান। উদ্ধারকারীদের আশা ছিল, হয়ত কোনো কারণে টাইটান পানির নিচে তলিয়ে গেছে, ভেসে উঠতে পারছেন না। যে কারণে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উদ্ধারকর্মীরা টাইটানের অবস্থান শনাক্ত করে সেটাকে তুলে আনতে চাইছিলেন। তাদের ভয় ছিল, ডুবোযানে সংরক্ষিত অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে সেখানে থাকা পাঁচ আরোহী দম বন্ধ হয়ে মারা পড়তে পারেন। 
 
উদ্ধার অভিযানের মধ্যেই স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে খবর আসে, আটলান্টিকের তলদেশে উদ্ধার অভিযানে পাঠানো রোবটযানটি টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে অন্য কিছুর ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পেয়েছে, যেটি পরে টাইটানের বলে নিশ্চিত করে মার্কিন কোস্ট গার্ড।

ধ্বংসাবশেষের কী হবে?

ডুবোযানটির ধ্বংসাবশেষ যতটা সম্ভব উদ্ধার করা অপরিহার্য। কার্বন ফাইবারে তৈরি টাইটানের কাঠামোর অংশ উদ্ধার করা গেলে কী ঘটেছে, তার একটি চিত্র পাওয়া যেতে পারে। সেটির ধ্বংসাবশেষে আটলান্টিকের কোন এলাকায় পাওয়া গেছে, তার একটি ম্যাপিংয়ের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

সমুদ্রের তলদেশ বিশেষজ্ঞ পল হ্যানকিন জানান, সাবমার্সিবলটির কোণাকৃতি পেছনের অংশসহ মূল কাঠামো ও বহিরাবরণের পাঁচটি টুকরো খুঁজে পাওয়া গেছে। অন্য অংশগুলোর কী অবস্থা, তা স্পষ্ট নয়।

ঘটনার তদন্ত কীভাবে হবে?

কানাডার পরিবহন সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত শুক্রবার বলেছে, ঘটনাটি তারা তদন্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (এনটিএসবি) বলছে, তাদের পাশাপাশি ওই ঘটনা তদন্ত করবে মার্কিন কোস্টগার্ড।

টাইটানের অভিযান শুরু হয়েছিল কানাডার পতাকাবাহী জাহাজ পোলার প্রিন্স থেকে। ফেডারেল ট্রান্সপোর্টেশন এজেন্সি থেকে তদন্তকারীদের একটি দলকে সাক্ষাৎকারের জন্য নিউফাউন্ডল্যান্ডে পাঠিয়েছে কানাডা। এক বিবৃতিতে কানাডা কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা অন্যান্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করবে।

মার্কিন কোস্টগার্ড কর্মকর্তা জন মাগার বৃহস্পতিবার বলেন, তদন্ত কেমন হতে পারে সেই বিষয়টি আলোচনার জন্য এই ঘটনা সঙ্গে জড়িত দেশগুলোর সরকার বৈঠক করছে। তদন্তের সঙ্গে জড়িত যে কেউ এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইবেন যে, অন্তর্মুখী বিস্ফোরণে টাইটানের আরোহীদের মৃত্যু হয়েছে। আর যদি তাই হয়, তবে সেটি কখন এবং কেন ঘটেছে।

তিনি আরও জানান, বিস্তৃত পরিসরে এমন ডুবোযানের প্রবিধান এবং মান সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো ভবিষ্যতের পর্যালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে।

টাইটানের ব্যাপারে তথ্য পেতে সম্ভাব্য আরেকটি উৎস হতে পারে হাইড্রোফোন। পানির নিচে এই মাইক্রোফোন দিয়ে অবৈধ পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার শব্দ শোনার জন্য ব্যবহৃত হয়। ২০১৭ সালে উপকূল থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর আর্জেন্টিনার সাবমেরিন সান জুয়ান যে বিস্ফোরিত হয়েছিল, সেটি নিশ্চিতে এই প্রযুক্তি সহায়তা করেছিল। টাইটানের খোঁজে দূর নিয়ন্ত্রিত ডুবোযান বা আরওভি আটলান্টিকের তলদেশে পৌঁছায় টাইটানের খোঁজে এই দূর নিয়ন্ত্রিত ডুবোযান বা আরওভি আটলান্টিকের তলদেশে পৌঁছায়।

হাইড্রোফোনগুলো হয়ত টাইটানের শেষ পরিণতি রেকর্ড করেছে। আর কখন সেই ট্র্যাজেডি ঘটেছে তার হয়ত সঠিক সময় বলে দিতে পারে। নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, টাইটানের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে যাওয়ার পরই ‘অন্তর্মুখী বিস্ফোরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ’ শব্দ শনাক্ত করেছে মার্কিন নৌবাহিনী।

কার্বন ফাইবার পরীক্ষা!

ব্রিটেনের রয়্যাল নেভির প্রাক্তন সাবমেরিন ক্যাপ্টেন রায়ান রামসে বলছেন, এ দুর্ঘটনা কেন ঘটল এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে- সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কর্তৃপক্ষ টাইটানের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া প্রতিটি টুকরো সংগ্রহ করবে।

“সেখানে কোনো ব্ল্যাক বক্স নেই, তাই আপনি ডুবোযানটির শেষ গতিবিধি শনাক্ত করতে পারবেন না। এ বিষয়টি বাদ দিলে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াটি হবে বিমান দুর্ঘটনার তদন্তের মতোই।”

রায়ান রামসে বিবিসিকে জানান, টাইটানের ধ্বংসাবশেষের টুকরোগুলো একবার পৃষ্ঠে তুলে আনতে পারলে তার কার্বন ফাইবার কাঠামো পরীক্ষা করবে কর্তৃপক্ষ। তখন হয়ত জানা যাবে– শেষ মুহূর্তে টাইটানের কী হয়েছিল?

কার্বন ফাইবার ফিলামেন্টের কাঠামো পরীক্ষার জন্য প্রতিটি টুকরো একটি মাইক্রোস্কোপ দিয়ে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা হবে। টাইটানের গায়ে ফাটল বা ছিদ্র ঠিক কোথায় হয়েছিল, সেটি জানতে কার্বন ফাইবারে চিড় বা ফাটল মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজে দেখা হবে, যেখান থেকে সেই ‘অন্তর্মুখী বিস্ফোরণ’ ঘটেছে।

ডুবোযানটির কাঠামাগত কোনো ত্রুটি ছিল কিনা, মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষার মাধ্যমে বড় এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবেন তদন্তকারীরা।

 
ছবি: বিবিসি

Post a Comment

0 Comments